তসলিমা নাসরিন: প্রশ্ন : প্রায় ২৮ বছর আগে আপনাকে যখন বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে তখনও আপনার বয়স ৩২ হতে ১৭ দিন বাকি। আজকের তসলিমা নাসরিন কীভাবে দেখেন সেদিনের সেই জেদি, আপোষহীন, বেপরোয়া, দিন বদলের সবুজ স্বপ্নে বিভোর, সদ্য ৩০ পেরোনো তরুণী তসলিমা নাসরিনকে? কখনো নিজেরই নিজেকে দেখে অবাক লাগে না? কোথা থেকে এতটা সাহস পেয়েছিল সেদিনের সেই মেয়েটি?
উত্তর : পেছনে তাকালে অনেক কিছুই অবিশ্বাস্য মনে হয়। কোত্থেকে অত দৃঢ়তা, অত মনোবল আর সাহস আমি পেয়েছিলাম! আসলে কোথাও থেকে পাইনি। কৈশোর থেকেই আমার নিজের ভেতর জন্ম নিয়েছিল সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের জন্য যতদূর যাওয়া যায়, গিয়েছি। ধর্মান্ধ, মৌলবাদী আর নারীবিদ্বেষীদের তুচ্ছ করেছি, তাদের হুমকিতে ভয় পাইনি, সে কারণেই একা আমি সমাজের প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। রাষ্ট্রের এবং সমাজের কোনও শাসককেই পরোয়া না করে, ফতোয়াকে, মাথার মূল্যকে, লক্ষ লক্ষ মৌলবাদী-জিহাদিদের হুমকিকে উপেক্ষা করে দেশে বাস করতে চেয়েছিলাম।
উত্তর : অল্প বয়সেই টের পেয়েছি সংসারে আমার মায়ের চেয়ে মূল্যবান আমার বাবা, আমার আর আমার বোনের চেয়ে মূল্যবান আমার দাদারা। আমাদের চেয়ে ওদের স্বাধীনতা ছিল অনেক বেশি। বৈষম্য নিয়ে সেই অল্প বয়স থেকেই প্রশ্ন করেছি। প্রশ্ন করাটা কেউ শেখায়নি যদিও।
আমাদের বাড়ি ছিল হিন্দু পাড়ায়। দাদারা প্রেম করতো হিন্দু মেয়েদের সঙ্গে, ওদের নিয়ে কবিতা লিখতো। আমি আর আমার বোনও পাড়ার হিন্দু ছেলেদের প্রেমে পড়তাম। স্কুলের সহপাঠীরা, শিক্ষক শিক্ষিকারা হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান বৌদ্ধ-সব ধর্মের ছিল। সবাইকে সমান চোখে দেখতাম। ধর্ম-বিশ্বাস ভিন্ন বলে কেউ কারও চেয়ে আলাদা, এমন চিন্তা দুঃস্বপ্নের মধ্যেও ছিল না। তবে জীবনের চলার পথে যখনই কোনও মেয়েকে বা কোনও সংখ্যালঘুকে নিয়ে অবজ্ঞা করে কেউ কথা বলেছে, প্রতিবাদ করেছি। লেখালেখিতে সেই প্রতিবাদ জোরালো হয়েছে আরও।
প্রশ্ন : এই আপোষহীন নাছোড় মানসিকতা, এই অদম্য জেদ, এই একরোখা বেপরোয়া প্রতিবাদ আপনাকে সারা বিশ্বের কাছে আইকন করে তুললেও তা পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে বা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে কতটা আঘাত করতে পেরেছে আপনার মনে হয়? আঘাত করলেও, কতটা পরিবর্তন করতে সমর্থ হয়েছে?
উত্তর : আঘাত তো করতে পেরেছেই। সে কারণেই তো আমাকে ২৮ বছর যাবত দেশে প্রবেশে বাধা দেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রব্যবস্থা বদলে ফেলার মতো পরিবর্তন ঘটেনি, তবে অসংখ্য ব্যক্তির ভাবনা-চিন্তায় পরিবর্তন ঘটিয়েছে। নারীর শৃঙ্খল ভাঙার জন্য, মৌলবাদের ভিত্তি গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য, সৎ, সাহসী, সেক্যুলার এবং সমানাধিকারে বিশ্বাসী জাতি গঠনের জন্য আমি যে ভাষায় কথা বলেছি, সে ভাষায় এখন কথা বলছে অনেকে।
প্রশ্ন : আজও দেশে ফিরে যেতে পারেননি আপনি, সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের ঘটনায় এখনো রাষ্ট্র নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে, মুক্তমনা ব্লগাররা এখনো নির্মম আক্রোশের শিকার হচ্ছে ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাতে, তাঁদের হত্যাও করা হচ্ছে–এই সবের পরিপ্রেক্ষিতে কখনো হতাশ লাগে না?
উত্তর : হতাশ তো লাগেই। একাত্তরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কত স্বপ্ন দেখেছিলাম। ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ পাবো, নারীর স্বাধীনতা পাবো, মতপ্রকাশের অধিকার পাবো। স্বপ্নগুলো এক এক করে ধসে পড়লো। পাকিস্তান থেকে পৃথক হওয়ার জন্য দীর্ঘ ন’মাস যুদ্ধ করেছি বাঙালিরা, সেই পাকিস্তানি প্রেতাত্মা আরও কট্টর হয়ে, আরও উগ্র হয়ে এখন মহাসমারোহে ফিরে আসছে। বাংলাদেশ জন্মেই ছিল ধর্মনিরপেক্ষ, দেড় দশকেই সংবিধান থেকে উড়িয়ে দেওয়া হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। একাত্তরে পথে ঘাটে স্লোগান দিয়েছি বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি। আর আজ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এনে অমুসলিমদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করা হয়েছে। আজ মরুর দেশের সংস্কৃতিকে এনে বাংলার সেক্যুলার সংস্কৃতিকে আঁস্তাকুড়ে ফেলা হচ্ছে। বোরখায় হিজাবে আলখাল্লায় ছেয়ে গেছে দেশ। সরকারের আস্কারায় মৌলবাদীরা মাথায় চড়েছে। মুক্তচিন্তকদের মধ্যে যারা ইসলামের সমালোচনা করে, তাদের একে একে খুন করা হয়েছে। আমাকে হাতের কাছে পেলে তো আমাকেই সবার আগে খুন করতো।
প্রশ্ন : বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারকে আপনি কীভাবে দেখেন? ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ তো মুক্তমনা, অসাম্প্রদায়িক একটি দল হিসেবেই নিজেদের দাবি করে–আর মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী, তিনি নিজেও একজন মহিলা; নারীস্বাধীনতা, মেয়েদের সমানাধিকার এসব নিয়ে তাঁর সরকার কতটা চিন্তান্বিত? আদৌ তাঁরা মুক্তমনা, অসাম্প্রদায়িক?
উত্তর : আওয়ামী লীগকে আগে অসাম্প্রদায়িক দল বলে ভাবতাম। এখন আওয়ামী লীগ আগাগোড়াই একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দল। সরকার নারীস্বাধীনতায় মোটেও বিশ্বাস করে না, বিশ্বাস করলে আমার আত্মজীবনী ‘আমার মেয়েবেলা’ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করত না, এবং সারাজীবন নারীর সমানাধিকারের জন্য যে আমি সংগ্রাম করেছি, আমাকে আমার নিজের দেশে প্রবেশ করতে বাধা দিত না।
প্রশ্ন : আপনার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সেই ’৬০, ’৭০ বা ’৮০–র দশকে বাংলাদেশের স্কুল বা কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের মধ্যে বোরখা পরার রেওয়াজ প্রায় ছিল না বললেই চলে। কিন্তু এখন এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রচুর মেয়ে বোরখা বা হিজাব ব্যবহার করছেন। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া সূত্রে প্রাপ্ত আরও একটি তথ্য আপনাকে জানাই–ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পড়ুয়া মেয়েরা নিজেদের নাম সইয়ের সময়েও নাকি হাতের দস্তানা খুলতে রাজি নয় পরপুরুষের উপস্থিতিতে! এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? যত দিন যাচ্ছে তত কি আমাদের চেতনা ধর্মীয় অনুশাসন ও সুসংস্কারের করালগ্রাসে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে?
উত্তর : বিভিন্ন সরকারি সহায়তায় দেশে কচুরিপানার মতো গজিয়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ওয়াজ কালচার ঢুকে গেছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সরকারগুলো ক্ষমতায় দীর্ঘকাল অবৈধভাবে থাকার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে। তার ফল দেখতে পাচ্ছি, হিজাব বোরখায় ইস্কুল কলেজ সয়লাব। মগজ ধোলাই হওয়া মেয়েরা হাতের দস্তানা খুলবে না, এ অবাক হওয়ার কিছু নয়। এর মধ্যেও মাথায় যথেষ্ট ঘিলু আছে যাদের, তারা মৌলবাদবিরোধী মুক্তচিন্তক হয়ে উঠছে। সরকার ধর্মান্ধ নারীবিদ্বেষীদের বাকস্বাধীনতার পক্ষে, কিন্তু মুক্তচিন্তকদের বাকস্বাধীনতার বিপক্ষে। সে কারণে মানবতাবিরোধী-বিজ্ঞানবিরোধী-নারীবিরোধী ধর্মের সমালোচনা তারা করতে পারে না। করলে হেনস্তা হতে হয়, জেল খাটতে হয়, নির্যাতন সইতে হয়, নির্বাসনে যেতে হয়। খুব খারাপ সময়ের মধ্যে আমরা বাস করছি। আশা করছি, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ প্রতিবাদ করবে, এবং অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে মুক্ত করবে সমাজকে।
প্রশ্ন : একটা জিনিস কি মনে হয় না যত দিন যাচ্ছে সব ধর্মেই উগ্র মৌলবাদ তত মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে? এটা কেন হচ্ছে? এক শ্রেণীর নিম্নরুচিসম্পন্ন রাজনীতিবিদের প্রচ্ছন্ন মদত কি রয়েছে এর পেছনে? ধর্মকে আশ্রয় করে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ঘৃণ্য রাজনৈতিক খেলা তো এখন বিশ্বজুড়েই চলছে।
উত্তর : উগ্র মৌলবাদ সব ধর্মেই ছিল এবং আছে। তবে ইসলাম ছাড়া বাকি ধর্মে যথেষ্ট পরিবর্তন এসেছে। মধ্যযুগীয় আইন এবং কানুন, সংস্কৃতি এবং শিক্ষা যদি আজ এই আধুনিক যুগে, এই একবিংশ শতাব্দীতে চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সমাজ সভ্য হবে না, এ স্বাভাবিক। সমাজকে পিছিয়ে রাখার জন্য চিরকালই দূরদৃষ্টিহীন ধুরন্ধর রাজনীতিকরাই দায়ী।
প্রশ্ন : শুধু বাংলাদেশেই যে আপনার একাধিক বইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল তা নয়, পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও আপনার ‘দ্বিখন্ডিত’ বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল একসময়। আপনাকে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়েও চলে যেতে হয়েছিল। রাজনৈতিক পালাবদলের পরও আপনার প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি বদল হয়নি বলেই আমাদের জানা। এ বিষয়ে যদি কিছু আলোকপাত করেন।
উত্তর : বাংলাদেশ মৌলবাদী দেশ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে বই ব্যান, আমার দেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা- এসব আমাকে অবাক করে না। আমাকে অবাক করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আচরণ। কোনও অন্যায় না করেও আমাকে শাস্তি পেতে হচ্ছে। আগের সরকার বই ব্যান করলো, আমাকে রাজ্য থেকে বের করলো। বর্তমান সরকার আগের সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমার টিভি সিরিয়াল ব্যান করলো, রাজ্যে আমার প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করলো। হয়তো আমিই ভুল ছিলাম, দুই বাংলা আলাদা নয় একেবারেই।
প্রশ্ন : আচ্ছা আপনি তো পৃথিবীর অনেক দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন, অন্যান্য দেশের মেয়েদের নিরিখে বাংলাদেশ আর ভারতের মেয়েদের অবস্থান এখন কেমন?
উত্তর : নিঃসন্দেহে অনেক পিছিয়ে আছে। কিছু মেয়ে সুশিক্ষিত, স্বনির্ভর। কিন্তু কিছু মেয়ের অবস্থা দিয়ে তো সব মেয়ের সার্বিক অবস্থার বিচার চলে না। পুরুষতন্ত্র যেসব দেশে বহাল তবিয়তে আছে, সেসব দেশে মেয়েদের সমানাধিকার বা সম্মান পাওয়ার জো নেই, এটা সহজ হিসেব।
প্রশ্ন : বর্তমানে আপনি কী ধরনের লেখালিখির মধ্যে আছেন? গল্প, কবিতা, উপন্যাস নাকি আত্মজীবনীমূলক নতুন কোন রচনা আগামী দিনে পাঠক আপনার থেকে উপহার পেতে চলেছে? নতুন কোনো বইয়ের পরিকল্পনা কি চলছে?
উত্তর : আমি ইদানীং ছোটগল্প লিখছি। আমাদের চারদিকে এত বিচিত্র সব ঘটনা ঘটছে, তাই খুব বেশি কল্পনার আশ্রয় নিতে হচ্ছে না, ঘটনাগুলোকেই গল্প আকারে তুলে ধরছি।
প্রশ্ন : আচ্ছা, এমন কোনো লেখা লিখেছেন যা শুধু পাঠককে নয়, আপনাকেও পরম তৃপ্তি দিয়েছিল?
উত্তর : যখন কিছু লিখি, তখন তৃপ্তি দেয় সে লেখা। কিছুকাল পর সে লেখা হয়তো ভালো লাগে না। কিন্তু কিছু লেখা আগেও যেমন আমাকে তৃপ্তি দিয়েছে, এখনো দেয়।
প্রশ্ন : বৃহত্তর সাহিত্যের আঙিনায় লিটল ম্যাগাজিনের শক্তিকে আপনি কীভাবে ব্যক্ত করবেন? জীবনের শুরুর দিকে আপনিও তো লিটল ম্যাগাজিন করতেন।
উত্তর : লিটল ম্যাগাজিন দিয়ে আমার লেখালেখির জীবন শুরু হয়েছে। লিটল ম্যাগাজিন এখন কতটা শক্তিমান আমি জানি না, তবে আমার সময় সেই সত্তর দশকে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন ছিল সাহিত্যের অন্যতম বলিষ্ঠ আন্দোলন।
প্রশ্ন : দুই বাংলা মিলিয়ে বাংলা ভাষার একদম নতুন প্রজন্মের কবি, লেখকদের লেখা আপনার কেমন লাগে? তাঁদের কাব্যভাষা বা গদ্যভাষা কতটা শক্তিশালী, কতটা সাহসী বলে আপনার মনে হয়?
উত্তর : গদ্যভাষা বা কাব্যভাষা হয়তো অনেকের চমৎকার, তবে সাহসী নয় খুব। আজকাল সাহস শব্দটির খুব নেতিবাচক অর্থ করে মানুষ।
প্রশ্ন : তসলিমা নাসরিনও তো একদিন ছোট্ট একটা মেয়ে ছিল। স্কুলে পড়ার সময়, পড়ার বই–এর ভেতর লুকিয়ে কোন কোন বই পড়তে ভালোবাসত সে? তারপর সেই ছোট্ট মেয়েটি একদিন অনেক বড়ও হয়ে গেল। এক পা দু পা করে গোটা পৃথিবী ঘুরে আসার ক্লান্তি আর অবসাদকে ঝেড়ে ফেলতে এখনই বা আনমনে কোন বই তিনি তুলে নেন হাতে?
উত্তর : বইপোকা ছিলাম ছোটবেলায়। পড়ার বইয়ের আড়ালে গল্পের বই পড়তাম। গোগ্রাসে পড়তাম, লাইব্রেরিতে এমন কোনো গল্প উপন্যাস ছিল না, যেগুলো পড়ে ফেলিনি। এখন ফিকশানের চেয়ে নন-ফিকশান পছন্দ।
প্রশ্ন : আমাদের শেষ প্রশ্ন, আপনার জন্ম হয়েছিল পরাধীন বাংলাদেশে। আপনার স্মৃতিচারণা থেকে জানতে পারি, মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকের সেই ভয়ংকর দিনগুলিতে আপনাদের ময়মনসিংহের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াতে হতো গ্রামে গ্রামে। তারপর দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীনতার ২৩ বছর পর আপনাকে সেই স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যেতে হলো। বলা ভালো জন্ম থেকে আজও আপনাকে পালিয়েই বেড়াতে হচ্ছে। এই স্বাধীন বাংলাদেশ কি কাম্য ছিল?
উত্তর : নিশ্চয়ই কাম্য ছিল না। আসলে স্বাধীনতার অর্থ না জেনে দেশ স্বাধীন করেছে মানুষ। পাকিস্তানি শাসকেরা আগে যেমন শোষণ করতো, ধর্ম চাপিয়ে দিত, স্বাধীনতায় বাধা দিত, স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকেরাও ঠিক তা-ই করে।
প্রশ্ন : আপনার যে–কোনো দুটো ইচ্ছের কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছে যা আপনি আজও সযতেœ লালন করে চলেন মননে– সারা পৃথিবীর মেয়েদের বা মানুষদের আপনি, তসলিমা নাসরিন, বিশেষ কোনো বার্তা দিতে চান?
উত্তর : মেয়েদের আর মেয়ে বলে অত্যাচারিত হতে হবে না কোথাও, মৌলবাদের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না, ভায়োলেন্স কী জিনিস মানুষ ভুলে যাবে, ধর্মের বইগুলোকে মানুষ প্রাচীন রূপকথা হিসেবে পড়বে, মানুষ সহিষ্ণু হবে, সহমর্মী হবে, সৎ এবং সাহসী হবে- এমন স্বপ্ন দেখি বলেই তো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লিখি।
বার্তা একটিই, সমাজকে সুস্থ এবং সভ্য করার জন্য যার যার সাধ্য অনুযায়ী কাজ করুন। এতে আপনি সরাসরি কোনো উপকার পাবেন না হয়তো, কিন্তু আপনার সন্তানেরা, সেই সন্তানদের সন্তানরা পাবে।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা । সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন